ব্রজভাষা কার লেখা? Who wrote in Braj Bhasha?
ব্রজ সাহিত্য
ভাষা একটি জাতির আত্মা, আর সাহিত্যে সেই আত্মার প্রকাশ। ব্রজভাষা—উত্তর ভারতের অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধ একটি উপভাষা, যেটি শুধুমাত্র ভাষাই নয়, এক গভীর আধ্যাত্মিক-সাংস্কৃতিক পরম্পরার বাহক।
ব্রজভাষা ও তার সাহিত্যিক উৎস
ব্রজভাষা হল পশ্চিম হিন্দি উপভাষাগুলির একটি শাখা, যা মূলত বর্তমান উত্তরপ্রদেশের মথুরা, বৃন্দাবন, আগ্রা ও আশেপাশের অঞ্চলজুড়ে প্রচলিত। এটি ১৫শ শতকে একটি সাহিত্যিক ভাষারূপে আত্মপ্রকাশ করে, বিশেষত ভক্তি আন্দোলনের সময়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভগবান কৃষ্ণের প্রতি ভক্তিপূর্ণ কাব্য ও সংগীত রচনার ধারা গড়ে ওঠে, আর সেই ধারাতেই ব্রজভাষা এক উজ্জ্বল রূপে ফুটে ওঠে।
এই ভাষায় লেখা সাহিত্যের মূল সুর ছিল—প্রকৃতির রহস্য, ঈশ্বরের সঙ্গে মানব আত্মার মিলন এবং এক আত্মিক প্রেমের বন্দনা। ব্রজ সাহিত্যের কবিরা অধিকাংশই সাধু বা ভগবান-উপলব্ধি প্রাপ্ত বলে মনে করা হতো, ফলে তাঁদের কাব্যকথা ঈশ্বরপ্রাপ্তির শুদ্ধ উচ্চারণ হিসেবে বিবেচিত হতো।
ব্রজ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য
- গভীর আধ্যাত্মিকতা ও ঈশ্বরভক্তির প্রকাশ
- কৃষ্ণলীলার কাব্যিক বর্ণনা
- রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের রসসম্মত উপস্থাপন
- সহজ ও সংগীতসুলভ ভাষাশৈলী
- মানব ও ঈশ্বরের মধ্যে এক আত্মিক প্রেমের বন্ধন
প্রধান সাহিত্যিক ও তাঁদের অবদান
ব্রজভাষায় সাহিত্যচর্চা করেছেন বহু বিখ্যাত কবি ও সাধক। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন—
- সুরদাস – তাঁর রচিত সুর সাগর একটি কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ। কৃষ্ণের শৈশবলীলার এমন অন্তরঙ্গ ও মানবিক চিত্রায়ণ হিন্দি সাহিত্যে বিরল।
- তুলসীদাস – যদিও তাঁর প্রধান কাব্য রামচরিতমানস অওধী ভাষায় রচিত, তথাপি তাঁর বিনয় পত্রিকাতে ব্রজভাষার প্রভাব স্পষ্ট।
- রাসখান – একজন মুসলিম কবি হওয়া সত্ত্বেও, তিনি কৃষ্ণভক্তির অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
- আমির খুসরো – সুফি ধারার পথিকৃৎ এই কবি ব্রজভাষায় সুফি প্রেম ও ঈশ্বর-ভক্তির গভীর চিত্র এঁকেছেন।
- আচার্য রামচন্দ্র শুক্ল – হিন্দি সাহিত্যের আধুনিক চিন্তাধারার সূচনা যাঁর হাতে।
- ভ্রিন্দ – কিশনগড়ের রাজদরবারে কর্মরত এই কবির ভ্রিন্দ সাতসাই অন্যতম বিখ্যাত কাব্য।
উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম
ব্রজভাষায় কিছু অমূল্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে—
- যুগল শতক – স্বামী শ্রীভত্ত দেবচার্য রচিত, যা নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের রাধাকৃষ্ণ উপাসনার উপর ভিত্তি করে।
- সুর সাগর – সুরদাসের অনবদ্য সৃষ্টি।
- বিনয় পত্রিকা – তুলসীদাসের ঈশ্বরপ্রেমের কাব্যিক উচ্ছ্বাস।
- ভ্রিন্দ সাতসাই – ভ্রিন্দ রচিত এই কাব্য শত শত ছন্দে কৃষ্ণের প্রেম ও লীলাকে তুলে ধরেছে।
ব্রজ সাহিত্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
ব্রজ সাহিত্য শুধু ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক কাব্য নয়, এটি একটি সময়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিত্র। কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সাহিত্য যেমন তাঁর শৈশবের দুষ্টুমি, তেমনি গভীর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরেছে। কৃষ্ণের জন্মভূমি বৃন্দাবনের সৌন্দর্য, গোকুলের পরিবেশ, যশোদার মাতৃত্ব, গোপীদের প্রেম—সবকিছু মিলে ব্রজভাষার সাহিত্য যেন এক জীবন্ত অভিজ্ঞতা।
ব্রজভাষা কে লিখেছেন—এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, এটি কোনো একক ব্যক্তির সৃষ্টি নয়, বরং এটি এক গোষ্ঠী, এক সংস্কৃতি, এক বিশ্বাসের সম্মিলিত আত্মপ্রকাশ। বিভিন্ন যুগে ভক্ত সাধক, কবি ও সাহিত্যিকদের কলমের ছোঁয়ায় এই ভাষা ও সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে, যা আজও আমাদের হৃদয়ে কৃষ্ণভক্তির নরম আলো জ্বালিয়ে রাখে।