শ্রী কৃষ্ণ কেন অর্জুনকে যুদ্ধ করতে বলেছিলেন ? স্বধর্ম পালন ও যুদ্ধ সম্পর্কে গীতার ধারণা কি ?
লেখক: স্বামী আত্মযোগানন্দ
Manusher Bhasha
"মম গতা সন্দেহঃ"—গীতার অন্তিম অধ্যায়ে এই কথাটি বলেছিলেন অর্জুন, যার অর্থ, ‘আমার সমস্ত সন্দেহ দূর হয়েছে।’
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ কেবল অস্ত্রধারণ নয়, এটি এক গভীর আত্মিক, নৈতিক ও দার্শনিক সংগ্রাম। মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যে শুধু দুই পক্ষের যুদ্ধ ছিল তা নয়—এটি ছিল ন্যায় ও অন্যায়, ধর্ম ও অধর্ম, কর্তব্য ও দায়িত্ববোধের মাঝে দ্বন্দ্ব। এই প্রসঙ্গেই প্রশ্ন উঠে: শ্রীকৃষ্ণ কেন অর্জুনকে যুদ্ধ করতে বলেছিলেন?
কুরুক্ষেত্র: যুদ্ধের প্রারম্ভে অর্জুনের সংকট
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে অর্জুন নিজ পরিবারের সদস্য, গুরুজন এবং বন্ধুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর অন্তরে জন্মায় গভীর মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণা ও নৈতিক সংশয়। তখনই শুরু হয় শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ—
শ্রীমদ্ভগবদ গীতা ।
অর্জুন বলেন:
"দৃষ্টিভেমমঃ স্ব-জনম কৃষ্ণ যুযুৎসুম সমুপস্থিতম
সিদন্তি মাম গাত্রাণী মুখাং চ পারিশুষ্যতি" - (গীতা ১.২৮)
বাংলা অনুবাদ: "হে কৃষ্ণ! যুদ্ধে আমার আত্মীয়-স্বজনদের দেখে আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অবসন্ন হচ্ছে, মুখ শুকিয়ে আসছে।"
এই দ্বিধা কাটিয়ে তুলতে শ্রীকৃষ্ণ যে যুক্তিগুলি প্রদান করেন, তা শুধু যুদ্ধের জয় নয়, বরং জীবনের বৃহত্তর উদ্দেশ্য উপলব্ধি ও আত্মসচেতনতার জাগরণ। তিনি অর্জুনকে মনে করিয়ে দেন তার স্বধর্ম, যা একজন ক্ষত্রিয়ের প্রধান ধর্ম—অর্থাৎ, ন্যায়সংগত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন:
"ক্ষত্রিয়স্য চ ধর্মে তে যুদ্ধে ন চাপ্যপপর্কীর্তিম্।
তস্মাত্ উত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধে কৃতনিশ্চয়ঃ।।" (গীতা ২.৩১)
বাংলা অনুবাদ: "হে কৌন্তেয়, তোমার জন্য একজন ক্ষত্রিয় হিসেবে ধর্মসম্মত যুদ্ধের চেয়ে উত্তম কিছু নেই। তাই দাঁড়াও ও যুদ্ধে দৃঢ়সংকল্প হও।"
শ্রীকৃষ্ণ এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব উপস্থাপন করেন—কর্মযোগ। তিনি বলেন, মানুষ তার প্রকৃতি অনুযায়ী কিছু কাজের প্রতি স্বাভাবিকভাবে প্রবণ। অর্জুন একজন ক্ষত্রিয়, যুদ্ধ তার ধর্ম। যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাওয়া মানে হবে তার প্রকৃত স্বভাব ও কর্তব্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া।
শ্লোক (শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৩.৩৫):
"শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াৱহঃ॥"
বাংলা অর্থ:
নিজের ধর্ম (কর্তব্য) দোষযুক্ত হলেও শ্রেয়; অন্যের ধর্ম (দায়িত্ব) নিখুঁতভাবে পালন করলেও তা ভয়ের কারণ। নিজের কর্তব্য পালনে মৃত্যু হলেও তা শ্রেয়; অন্যের কর্তব্য পালন বিপজ্জনক।
"অপরের ধর্ম যত সুন্দরভাবে পালন করা হোক না কেন, নিজের ধর্ম পালনই উত্তম—even যদি তাতে কিছু দোষ থাকে।"
এখানে শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্ট করেন যে, প্রকৃত ধর্ম মানে নিজের কর্তব্য পালন করা—তাতে যদি আপাতদৃষ্টিতে কষ্টকর বা বিপজ্জনক মনে হয়, তবুও তা ত্যাগ করা উচিত নয়।
যুদ্ধের প্রতি গীতার দৃষ্টিভঙ্গি
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ করতে বলেন কিন্তু অহিংসার চেতনা বিনষ্ট করে নয়। গীতার দর্শনে যুদ্ধ হলো "ধর্মযুদ্ধ"—ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য একটি অনিবার্য মাধ্যম। গীতা সন্ত্রাস বা হিংসার প্রশংসা করে না, বরং এমন অবস্থায় যেখানে অন্যায় প্রতিরোধ না করলে সমাজ ভেঙে পড়ে, সেখানে ধর্মের পক্ষে দাঁড়ানো কর্তব্য।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন:
"হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্।
তস্মাৎ উত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ।।" (গীতা ২.৩৭)
বাংলা অনুবাদ: "যদি তুমি যুদ্ধে মারা যাও, স্বর্গ লাভ করবে; আর যদি জয়লাভ করো, পৃথিবীতে রাজত্ব করবে। তাই, হে কৌন্তেয়, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।"
এই শ্লোকটিতে দেখা যায় যে গীতার দর্শন বাহ্যিক জয় বা পরাজয় নয়, বরং আত্মিক অবস্থান ও কর্তব্যপরায়ণতায় বিশ্বাস করে।
ধর্মযুদ্ধ ও অর্জুনের মানসিক সংকট
মহাভারতের প্রসঙ্গে আমরা জানি, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ছিল শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক যুদ্ধ নয়; এটি ছিল ধর্ম ও অধর্মের, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে সংঘর্ষ। এই যুদ্ধের প্রাক্কালে অর্জুন তার আত্মীয়স্বজন, গুরু ও বন্ধুদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।
তিনি তার ধনুর্বাণ নামিয়ে রেখে বলেন—
সংশয়যুক্ত অর্জুন বলেছিলেন:
"ন যদ্যস্যান্নিপত্যস্য মরাণং সেয়সো ভবেত্ |
তন্নেহং কর্তুমুচ্যামী ন হি প্রৈক্ষ্যে বিজয়ং পরান্ ||" (গীতা, অধ্যায় ১, শ্লোক ৩২-৩৩)
অর্থাৎ: "আমি এমন বিজয় চাই না যার জন্য আমাকে স্বজন, গুরুর রক্ত দেখতে হবে। মৃত্যুই যদি উত্তম হয়, তবে যুদ্ধ না করাই ভালো।"
এই বক্তব্য প্রমাণ করে অর্জুন কেবল এক যোদ্ধা নয়, একজন অনুভবশীল মানুষ, যিনি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তার কর্তব্য ও ধর্মের দ্বন্দ্বে পড়ে যান।
শ্রীকৃষ্ণের দর্শন ও কর্মযোগের শিক্ষা
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের এই বিভ্রান্তি দূর করতে তাঁকে কর্মযোগ, আত্মজ্ঞানের পথে পরিচালিত করেন। গীতায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—
"শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াৱহঃ॥" (গীতা, অধ্যায় ৩, শ্লোক ৩৫)
বাংলা অনুবাদ: নিজের ধর্ম পালন করে মৃত্যুবরণ করাও শ্রেয়, অন্যের ধর্ম পালন বিপজ্জনক।
অর্জুন একজন ক্ষত্রিয়, তাঁর স্বধর্ম হলো রক্ষা ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বোঝান— এই যুদ্ধ কোনো দুঃসাহসিক রক্তপাত নয়, এটি একটি ধর্মযুদ্ধ, যা ধর্ম রক্ষার জন্য অপরিহার্য।
যুদ্ধের নৈতিকতা: ধর্মযুদ্ধ বনাম সন্ত্রাস
গীতার দর্শন কখনোই সন্ত্রাসবাদ বা অন্ধ হিংসার অনুমোদন দেয় না। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন—
"হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্।
তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ॥" (গীতা, অধ্যায় ২, শ্লোক ৩৭)
বাংলা অনুবাদ: যুদ্ধ করলে হয় তুমি মরবে—স্বর্গে যাবে; নয়তো জিতবে—পৃথিবী ভোগ করবে। তাই, দাঁড়াও ও যুদ্ধ কর।
এখানে যুদ্ধ করার উৎসাহ মানে অন্ধ হিংসা নয়, বরং এটি একটি সুশৃঙ্খল, ন্যায়নিষ্ঠ কর্তব্য পালন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুধুমাত্র রাজত্বের জন্য ছিল না, এটি ছিল সত্যের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের পতনের লক্ষ্যে সংঘটিত এক ধর্মযুদ্ধ।
কর্মযোগ: বাহ্যিক কাজ, অভ্যন্তরীণ যোগ
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, আত্মত্যাগ বা সন্ন্যাস নয়, বরং কর্তব্য পালন করতে করতে ঈশ্বরচিন্তায় মন সংযুক্ত করাই প্রকৃত যোগ—
"যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।
সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে॥" (গীতা, অধ্যায় ২, শ্লোক ৪৮)
অর্থ: হে ধনঞ্জয় (অর্জুন), তুমি সফলতা বা ব্যর্থতার চিন্তা না করে সমভাবে কাজ করো। এই সমভাবই যোগ।
অর্জুন যুদ্ধ করছে, কিন্তু তার মন ঈশ্বরচিন্তায় স্থিত। এটি কর্মযোগের আদর্শ চিত্র— বাহ্যিকভাবে দায়িত্ব পালন ও অভ্যন্তরীণভাবে আত্মসংশ্লিষ্টতা।
যুদ্ধ নয়, কর্তব্যই মুখ্য
গীতার যুদ্ধ এক প্রতীক, যা আমাদের শেখায়— জগতের প্রতিটি কাজই যদি ঈশ্বরার্পিতভাবে করা যায়, তবে তা হয়ে যায় ধ্যানের সমান। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝান, পালিয়ে যাওয়া নয়, বরং দৃঢ় মন নিয়ে নিজের ধর্ম পালন করাই সত্য পথ।
যুদ্ধ কি শুধুই রক্তপাত? নাকি একটি আত্মসংশোধনের উপায়?
গীতায় কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের উপমা ব্যবহার করে জীবনের প্রতিটি ধর্মসঙ্কট ও কর্তব্যসঙ্কটের সমাধান করা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ করতে বলেন, কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিল আত্মানুসন্ধান ও নিষ্ঠার বিকাশ। এখানে যুদ্ধ একটি প্রতীক— আমাদের নিজের ভেতরের দোষ, মায়া, ভয়, দ্বিধা, কামনা, মোহের বিরুদ্ধে সংগ্রামের।
"যথৈধাংসি সমিদ্ধোऽগ্নির্ ভস্মসাৎ কুরুতে অর্জুন।
জ্ঞানোऽগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা॥" (গীতা, ৪.৩৭)
অর্থ: জ্ঞানের আগুন সমস্ত কর্মকে দগ্ধ করে দেয়।
এই জ্ঞানই অর্জুনের ভেতর জাগিয়ে তুলেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ, যা তাকে কেবল একজন যোদ্ধা নয়, একজন আত্মজাগ্রত কর্মযোগী করে তোলে।
অহিংসার দর্শন বনাম ধর্মযুদ্ধ
অনেকেই প্রশ্ন করেন— গীতা কি হিংসার অনুমতি দেয় ? এর উত্তর গভীরে লুকিয়ে আছে। গীতা কোনো ভাবেই অকারণ রক্তপাত বা হিংসার সমর্থন করে না। শ্রীকৃষ্ণ কখনোই বলেননি, "হত্যা করো"; বরং তিনি বলেছেন—
"য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হতম্।
উভৌ তৌ ন বিজানীতঃ নায়ং হন্তি ন হন্যতে॥" (গীতা, ২.১৯)
বাংলা: যে ভাবে সে কাউকে হত্যা করছে কিংবা কেউ তাকে হত্যা করতে পারে— সে বোঝে না। আত্মা অজ, অবিনশ্বর, অহিংস।
অতএব, গীতার যুদ্ধ শরীরের নয়, আত্মার নয়, বরং অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মের প্রতিষ্ঠার লড়াই। শ্রীকৃষ্ণ চেয়েছেন এই আত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে অর্জুন যেন দায়িত্ব পালন করেন— দ্বেষ নয়, দায়িত্ব।
গীতার যুদ্ধচিন্তা: আত্মার মুক্তির পথ
গীতা কেবল এক দর্শন নয়, এটি জীবনের একটি নির্দেশপথ। যুদ্ধ এখানে তিনটি স্তরে বিশ্লেষণযোগ্য:
1. বাহ্যিক যুদ্ধ — যেটি কুরুক্ষেত্রে ঘটেছে, এটি অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মের প্রতিষ্ঠা।
2. মানসিক যুদ্ধ — অর্জুনের ভেতরে দ্বিধা, ভয়, মোহ, করুণা, অহংকার ইত্যাদির টানাপোড়েন।
3. আধ্যাত্মিক যুদ্ধ — আত্মজ্ঞান, কর্মযোগ ও ঈশ্বরস্মরণে প্রবেশ।
শ্রীকৃষ্ণ চান, অর্জুন এই তিনটি স্তরেই জয়লাভ করুক। শুধু শত্রুদের পরাজিত করলেই অর্জুন বিজয়ী নয়, বরং আত্মসন্দেহ, মোহ, ও কল্পিত দুর্বলতার জয়— এটিই প্রকৃত বিজয়।