ধারাবাহিক উপন্যাস - সময়ের স্বর্ণরেণু
দ্বিতীয় ভাগ। প্রবীর রায় চৌধুরী
মানুষের ছবি
বহমান সময়ের সাথে
সাথে আমরা কত কিছু ফেলে আসি। তীব্র গতির জীবন
সংগ্রামের ঘূর্ণিপাকে তলিয়ে যায় কত মণিমুক্তো-সম স্মৃতি।এই জীবনের মহাসমুদ্রের বালুতটে
মহাগর্জনে আছড়ে পড়ে অবিশ্রান্ত ঘটনার ঢেউ।
কোনটা বড় , কোনটা ছোট। বলা হয় , সমুদ্র নাকি সবই ফিরিয়ে দিয়ে যায়। চাইলে খুঁজে পাওয়া যায় তার বিস্তীর্ন বালুতটে।তাই
এই ভ্রমণ , তাই খুঁজে ফেরা সেই বালুতটে - জীবনের
ফেলে আসা সময়ের স্বর্ণরেণু।
এবাড়িতে সকালের ঘুম ভাঙত একটু
অন্যরকম ভাবে।আগেই বলেছি উইক ডে-র সকাল মানেই এবাড়িতে সবার অফিস নয়তো স্কুল যাওয়ার
তাড়া।সারারাত বিভিন্ন সাহিত্য ও নাট্যচর্চা করে ক্লান্ত জ্যাঠামশাই রাট আড়াইটে তিনটের
দিকে পুকুরের দিকের বাগানে তার নিজের ঘরে গিয়ে হয়তো শুয়ে নিতো। তারপর নিখুঁত সকাল সাড়ে পাঁচটায় অবশ্য কর্তব্যের
মতো বেরিয়ে পড়তেন। সুঠাম লম্বা চেহারা , প্রায়
পাঁচফুট দশ - ঋজু চেহারা। মাথার চুল প্রায় সাদা। গায়ের রং দুধে আলতা। গায়ে গামছা ঘষলে মনে হতো রক্ত জমে গিয়েছে। চোখের
মনি সামান্য নীলাভ। কখনো রবীন্দ্রনাথের মতো , কখনো শেক্সপিয়ারের মতো দাড়ি রাখতো। আবার কখনো তাদের ওপর রাগ হলে এক্কেবারে ক্লিন সেভ। কখনো প্রাচীন ইতিহাস , মিথলজিতে ব্যস্ত , তখন তার
লুক ও সেরকম , আবার কখনো এক্কেবারে খাঁটি ব্রিটিশ স্টাইল। তখন আর সাদা পাজামা পাঞ্জাবি
নয়। পুরো প্যান্ট-শার্ট। টিপ্ টপ। ভোর পাঁচটায় মুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হতে কিছু
সময় যা লাগতো। তারপর বেরিয়ে পড়লো হাতে পাঁজি
নিয়ে। আমাদের ঘুম ভাঙতো যখন জ্যাঠামশাই আমাদের
জানলার পাশ দিয়ে চলে যেতেন। উদাত্ত কণ্ঠে আওহ্বান
- অনেকটা এইরকম , "জাগো জাগো জাগো , আজ
১৪ ই আষাঢ় ১৩৮৪ বঙ্গাব্দ , ইংরেজি ২৯ সে জুন ১৯৭৮ , শুক্রবার , , সূর্যোদয় ৪.৫৮ মিনিটে
, অসভ্যের মতো এখনো ঘুমিও না , সূর্যাস্ত ৬.২৪ মিনিটে.... ইত্যাদি। মাঝখানের কথাটা পাঁজিতে লেখা থাকতো না , সেটা জ্যাঠামশাইয়ের
নিজের সংযোজন। কর্মবীর যেন , সারাক্ষন কিছু
করতে হবে , আর পড়ে যেতে হবে। কিছু হাতের কাছে
না থাকলে উঠোনে কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করে নিয়ে ঝাঁটার কাটি দিয়ে হলেও লিখে যেতে হবে। হয়তো সেই সময়ে কোনো বিখ্যাত সাহিত্যিকের কোনো লেখার
বা কবিতার সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখছেন , বা টেনিসন বা শেলীর কবিতার কয়েকটি লিখে ঝালিয়ে
নিচ্ছেন। এমন সময় চা নিয়ে ছোটোপিসি সামনে হাজির
হলেই মুশকিল। "যাহঃ মুড্ তা বিগড়ে দিলি
... গার্লস স্কুলের মূর্খ দিদিমনি ! যা দূর হ এখান থেকে। ছোটপিসি বিড়বিড় করে চায়ের
কাপটা ঠক করে নামিয়ে রেখে যেতে যেতে বলতো - যাহ , তোকে আর কোনোদিন চা দেব না। কিন্তু
কোনো কোনো দিন দেখতাম ছোটোপিসির চোখের কোন জল।
বারান্দায় বসে দূর থেকে জ্যাঠামশাই কে উঠোনে লিখতে দেখছে , আর কাপড়ের আঁচল দিয়ে
চোখ মুছতে মুছতে বলছে , ভগবান নেই , ভগবান বলে কিছু নেই। এই রকম একজন অসামান্য প্রতিভা , একটা অমূল্য রতন
, তার কি হলো। আজ পুরো সুস্থ থাকলে সমাজের
কত উপকারে লাগতো। পাশে যদি আমাদের কাউকে দেখে
ফেলতো , তখন তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ধমকের স্বরে বলতো - শোনো , তোমরা যেন বোরো হয়ে জ্যাঠামশাই
হয়ে যেও না। আমরা ছোটরা অনেক সময় জিজ্ঞাসা করতাম কেও ? জ্যাঠামশাই কি অন্যায় করেছে
? তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাদের মাথায় হাত রেখে বলতো - ও তোমরা এখন বুঝবে না , বড়
যন্ত্রনা , বড় যন্ত্রনা। আজ জ্যাঠামশাইয়ের তখনকার বয়েসে এসে যখন এসব বলছি , আর চারিদিকে
তাকাচ্ছি - দেখছি মানুষ কত উগ্র , হিংস্র , প্রতারক হতে পারে তার প্রতিযোগিতায় মেতেছে
, ৫০% পৃথিবী যুদ্ধে লিপ্ত , দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার সীমাহীন হতে হতে এমন পর্যায়ে
পৌঁছেছে যে অসহায়ের শেষ আশ্রয় আদালত ও আজ পঙ্গু , স্থবির কখনো নিজেই লজ্জিত , তখন মনে
হয় , জ্যাঠামশাই হয়ে যেতে। নির,নির্মল মন
, একবুক ভালোবাসা , ঠোঁটের কোন ভুবন ভোলানো হাসি।
এক কাপ গরম চা -তাই তিনি খুশি। আর চাই
বই। ভাবি আজকের ইন্টারনেটের যুগে এই মানুষগুলো
কত খুশি হতেন , যেখানে হাতের মধ্যে আঙুলের টোকায় স্মার্টফোনের স্ক্রিনে ফুটে ওঠে সারা
দুনিয়া। এটাও তো অনেকটা বিশ্বরূপ দর্শন।
যে দিনের কথা শুরুথেকে বলতে গিয়ে এতো কথার সূত্রপাত
, সেদিন কোনো কারণে আমাদের স্কুল ছিল ছুটি।
আগের দিন টিফিনের পরের ক্লাসে আঁকার স্যার ক্লাসে এসে প্রথমে একটা বড়ো হাই তুললেন
, তারপর মানুষের শরীর কিভাবে একটা হয় সেটা নিয়ে বলতে শুরু করলেন। বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি র
সম্পর্কে প্রথম পরিচয় ঘটালেন। সেখান থেকে চলে
আসলেন অবনীন্দ্রনাথে। দ্য ভিঞ্চির আয়নাটমীর
উপর কি বিশাল দখল ছিল সেটাও বললেন। আর এনাদের
নাম গুলো খাতায় লিখে নিতে বললেন। এতটা বক্তৃতা
ভীষণ আবেগ ও তার সাথে বিস্তর হাত-পা ছুঁড়ে , মানে সারা শরীর দিয়ে বুঝিয়ে ও তারস্বরে
চিৎকার করে আঁকার স্যার সুনীলবাবু খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। মাথাটা ঠান্ডা করার জন্য ডেস্কে হাত দিয়ে মাথাটা
ধরে , যাকে বলে মাথা গুঁজে বসে থাকলেন। হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছিলেন। লম্বা থামের মতো চেহারা , কুচকুচে কালো গায়ের রং।
সঙ্গে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। অনেকটা মৃনাল সেনের স্টাইলে চলতেন। আর মনে করতেন উনি ছাড়া বাকি সবাই প্রায় অশিক্ষিত।
বা অর্ধ শিক্ষিত। তাই নিয়ে মাঝে মাঝেই টিচার্স
রুমে ধুন্ধুমার বেঁধে যেত। গ্রামের সরকারি স্কুল।
এই শিক্ষকরা অধিকাংশই কলকাতা বা অন্য্ দূরস্থান থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করতেন। কেউ কেউ গ্রামেই ভাড়া বাড়িতে থেকে যেতেন। কিন্তু সুনীলবাবু কখনোই ভাড়া বাড়িতে থাকেননি। বলতেন তাতে নাকি চিন্তার প্রসার কমে যায় , দাসত্ব
জন্ম নেয় , আর কলকাতা ছেড়ে দুদন্ড থাকার কথা তিনি ভাবতেই পারেন না। নন্দন , একাডেমি , কলামন্দির এসব তার কাছে হীরের
গয়নার থেকেও দামি। আর সেখানে কাটানো সময় , জমাটি তর্ক , অথবা আড্ডা সেটাই তাঁর প্রাণবায়ু। যাই হোক
স্যার যেই ঘুমিয়ে পড়েছেন , অমনি পিছনের বেঞ্চের প্রলয় চোখ আর ঠোঁট বেঁকিয়ে এমন একটা
ইশারা করলো যা বাকি ক্লাসের কারোর বুঝতে বাকি থাকলো না। মানেটা
পরিষ্কার - চলো ভাইসব , শুরু হো জায়ে ! সঙ্গে সঙ্গে বিপুল বাক্স পেটানো , শিস
, বেঞ্চিতে নাচ , সম্মিলিত অকারণ ও অবোধ্য মুখের বিকট চিৎকারে সারা ক্লাস তখন ফেটে
পড়ার জোগাড়। এই শুনেই সম্ভবত , হঠাৎ সামনের
দরজায় একটা স্থির মূর্তি। বেঁটেখাটো কালো চেহারা। বাটারফ্লাই গোঁফ , ঈষৎ ভুঁড়ি। সাদা জামা কালো প্যান্ট। যার চোখের চাহনিই আদেশের নামান্তর। তিনি আর কেউ নন। হেডস্যার।
মুহূর্তে সারা ক্লাস স্ট্যাচু খেলার মতো হয়ে গেলো। যে যে ভঙ্গিতে ছিল সে সেখানে
সেইভাবেই যেন জাদু ছড়ির নির্দেশে স্থির , নিশ্চল।
নিঃশব্দ চতুর্দিক। হেডস্যার ভিতরে ঢুকলেন।
আবার কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন।শব্দ তরঙ্গের এই বিপুল হেরফেরে বোধহয় আঁকার স্যারের
ঘুম ভেঙে গেলো। তিনি মাথা সোজা করে চোখ কচলে
সবাইকে দেখে খুব খুশি হলেন। একগাল স্মিত হেসে
বললেন , লক্ষি ছেলেরা। ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিত
সব শিশুরই অন্তরে। কেন বললেন তখন বুঝলাম না। উনি মাঝে মাঝেই এরকম কবিতার লাইন আওড়ে উঠতেন , আর
এক এক সময় এক এক রকম ভঙ্গিতে আপন মনে মাথা নাড়তেন। অনেকটা যেন জ্যাঠামশাইয়ের মতো মানুষ। আমার তাই ওনাকে খুব ভালো লাগতো। স্যার ক্লাস থেকে
যাওয়ার সময় বললেন, কাল স্কুল ছুটি।
পরশু সবাই একটা করে মানুষের ছবি এঁকে আনবে। অন্য্ ক্লাস গুলোতে কারোরই খুব একটা
মন বসলো না। সুযোগ পেলেই পেন্সিল দিয়ে বেঞ্চিতে
মানুষের ছবি আকার চেষ্টা করল। ধরা পরে অঙ্কের
স্যারের ধমকও কেউ কেউ খেল।এই করে সেদিন স্কুল ছুটি তো হলো। আনন্দটা আরো বেশি কারণ পরের দিন ছুটি। শুধু গেট দিয়ে বেরোনোর সময় , পাশেই পরে হেডস্যারের
ঘর , সেখান কানে এলো থেকে উত্তপ্ত বাঘ সিংহের গর্জন। সুনীলবাবু আর হেডস্যার। সুনীলবাবু বলে চলেছেন....বাচ্চাদের মর্নিং স্কুল
সিস্টেমটাই উঠে যাওয়া উচিত। োর চেচিয়েছে বেশ
করেছে। আপনার মতো মানুষ শৈশবের শত্রু ... ইত্যাদি
ইত্যাদি। সেটা আর কতক্ষন চলেছিল জানিনা। তবে সবাই বুঝেছিলাম আঁকার স্যার আমাদের দলের লোক। খুব ভালো মানুষ। আমাদের সেরা স্যার।
এখন থেকেই পরের
দিনের সকালের কান্ডটা শুরু। এখানে বলে রাখি , আমার মা ছিল দক্ষ চিত্রশিল্পী। কলকাতার মেয়ে , গ্রামে বিয়ে হলেও আঁকার পাঠ মা কখনোই
ছাড়ে নি। সে কথা পরে আবার বলব। কিন্তু সেদিন
স্কুল থেকে ফিরে সন্ধ্যেবেলা মা কে পরের দিনের স্কুলে মানুষের ছবি এঁকে নিয়ে যাওয়ার
কথাটা বলতে মা বললো চেষ্টা কর। আমি বললাম একটু
এঁকে দাও। মা বললো আগে নিজে নিজে চেষ্টা করো
, দরকারে অনেকবার চেষ্টা করো। তারপর দেখা যাবে।
পরদিন সকালে জ্যাঠামশাইয়ের পাঁজি পর্ব মিটে সকলের চায়ের তোড়জোড় চলছে। আমার ছুটির দিন সক্কাল বেলা বাড়ি পরিক্রমা হয়ে গেছে। হাফিয়ে গিয়ে বারান্দার একপাশে বসে আছি। হঠাৎ নজর
গেলো বাগানে জ্যাঠামশাইয়ের দিকে। লিচু গাছের
গোড়ায় একটা ভাঙা ইট-সুরকির ভাঙা চাঁই পাথরের মতো পরে ছিল। জ্যাঠামশাই হাতে অক্সফোর্ড ডিক্সনারিটা নিয়ে সেখানে
পায়ের ওপর পা তুলে বসলেন। তারপর বাড়ির দিকে
খুব বিরক্তি সহকারে এক দুবার তাকিয়ে নিয়ে মুখ দিয়ে ফুহহ -এরকম একটা আওয়াজ করলেন , মানে
চা আসতে দেরি হচ্ছে। কেন হচ্ছে ? এসব দেখতে
দেখতে আমার হঠাৎ মনে হলো , আরে , জ্যাঠামশাই তো একটা মানুষ। স্যার তো একটা মানুষ , মানে মানুষের মতো মানুষকে
দেখে মানুষের ছবি আঁকতে বলেছেন। তাহলে এই তো সুযোগ ছবি আঁকার । জ্যাঠামশাই এখন বেশ খানিক্ষন ওখানে ওই ভাবেই বসে
থাকবে।নড়বে না চড়বে না। আজ যেহেতু হাতে ডিকশনারি
,তাই আজ মাথায় নাড়বে না। দারুন হবে। আমার আর তোর সইছে না। দুধ বিস্কুট নিয়ে
একবার মা , আর
তারপর ছোটোপিসির জোড়াজুড়ির পর সেটা কোনোরকমে ঢোক গিলে নিয়ে ছুটলাম পড়ার ঘরে। স্কুলের বাক্স থেকে আঁকার খাতা আর পেন্সিল নিয়ে
বসে পড়লাম শোয়ার ঘরের বিছানায় বাগানের দিকের জানলার পাশে। ওই জানলাটা দিয়ে লিচুগাচতলাটা খুব কাছ থেকে দেখা
যায়। বার বার দাগ কেটে জ্যাঠামশাই রুপি মানুষের
মাথাটার আকার আনার চেষ্টা করছি , আর বার বার সেটা কখনো নৌকো , কখনো আপেলের মতো হয়ে
যাচ্ছে। মাঝে ছোটোপিসি জ্যাঠামশাইকে চা দিয়ে
গিয়েছে। বাড়িতে কুকুর বিড়ালের অভাব নেই। জ্যাঠামশাইয়ের
পেটোয়া তিনটে কুকুর তাকে পাহারা দিচ্ছে। বিস্কুটের ভাগ তারা ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে। মামার তো মনে হয় এবাড়ির বিস্কুটের টিনের বেশিরভাগ
বিস্কুট ওরাই খায়। মানুষের জন্য আনা হয় মাত্র। ওটা মন ভোলানো। এবাড়ির কুকুর বেড়ালদের
তোয়াজ কখনো কখনো মানুষের চেয়েও বেশি , কখনো কম্পিটিশনের মতো হয়ে যেত। কারন সবার কুকুর আর বিড়াল আলাদা আলাদা। তাদের নামও আলাদা আলাদা। কুকুরের নাম যেমন মুখপোড়া , থুম , টম , ভুট্টু
, ভুতরে , এলিয়েন , তুষার চিতা , তেমনি বিড়ালের নাম কত বলবো - টেই , লোটাস , লেপার্ড
, খুশি , চন্দ্রমল্লিকা , সন্ন্যাসী আরও কত কি।
সবার নামের সাথেই এক একটা গল্প জড়িত।
সবার নামের মধ্যেই তাদের একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ ধরা পড়তো। সে কথা প্রসঙ্গান্তরে বলবো। যাই হোক, কতক্ষন কেটে
গেছে জানিনা , আমি মানুষ আঁকা নিয়ে অনেক নাটা ঝামটা হয়ে শেষে একটা কিছু এঁকে ফেললাম। আমার মনে হলো খুব ভালো হয়েছে। যেন সত্যিই জ্যাঠামশাই
বসে আছে গাছের তলায়। সামনে একটা কুকুর। খাতাটা
নিয়ে উঠে পড়লাম। সবাইকে দেখতে হবে , কেমন হয়েছে।
আমার এই ইচ্ছার যে এই পরিণতি হবে কে ই বা তখন জানতো ? ব্যাপারটা খুলে বলি।
হলিডে বলে আজ
সবাই বাড়িতে। কাজের লোকেরাও সকলে চলে এসেছে। জন মজুররা বাগানে একটু সকালের চা-বিড়ি খেয়ে প্রস্তুতি
নিচ্ছে। আজ এক একজন বাবুর এক এক রকম আদেশ হবে। এমন হতে পারে সকালে যে কাজ করতে বলেছিলো দুপুরের
দিকে সেটাই ভেগে ফেলতে বললো। এদের মর্জি আজও
কেউ বোঝেনি। যাকগে যাক , রোজ এর দাম পেলেই হলো।
এমনও দিন গেছে বাবা অথবা , ছোটকাকা বীর বিক্রমে হাঁকা ডাকা করে বাগানে গেলেন
আর রহিম চাচা , শুকদেব বা মাদার চাচার সাথে হয় কোনো নাটকের সিন্ বোঝাতে লাগলেন বা নতুন
কোনো আবিষ্কার নিয়ে অবাক ভরা বক্তৃতা দিতে থাকলেন। সেদিন হয়তো কোনো কাজই হলো না। ছোটোপিসি এসব দেখে বলতেন , নামে তালপুকুর , এমনিতেই
ঘটি ডোবে না , আর এদুটোয় মাইল সেই পুকুরে এবার চড়া ফেলে দেবে দেখছি। আর পারিনা।
সর্বস্ব লুট হয়ে গেলো।
হাতের কাছে বাবাকে
পেয়ে গেলাম। পাজামা আর হলুদ ফতুয়া পরে বাগানে
জবা গাছের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটিপ নস্যি। চোখের দৃষ্টি আকাশের দিকে , উদ্দেশ্যহীন।মানে আসলে
ওই সময়ে বাবার মাথায় নানা আবিষ্কারের আইডিয়া ঘুরে ঘুরে করছে। উনি তখন ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কিন্তু আসলে নেই। মনে
মনে চলে গেছেন হয়তো আইনস্টাইনের বসার ঘরে , বা রকেটে করে অন্য্ গ্রহের পথে। আঁকার খাতাটা দিয়ে একটা খোঁচা দিলাম বাবার পিঠে। বিড়ালের গায়ে জল দিলে যেমন লাফিয়ে সরে যায় বাবাও
যেন তেমনই ভয় পেয়ে গেলো। একলাফে দু পা সরে
গিয়ে চোখ মোটা করে তাকালো। কিন্তু হাতে খাতা
পেন্সিল দেখে খানিকটা সামলে নিলো। বললো কি
এনেছিস ? কিছু বলবি ?
আমি বললাম কি
এঁকেছি দেখো।
বাবা হাত থেকে
খুব উৎসাহ ভোরে খাতাটা নিয়ে খাতাটা সোজা উল্টো করে , সেসঙ্গে ঘরটাকে এদিক ওদিক কাত
করে ছবিটা দেখতে লাগল। দেখছে তো দেখছে , মাঝে মাঝে দেন হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙ্গুল
দিয়ে নাক , ঠোঁট এসব চেপে ধরছেন , আর চোখটা কুঁচকে কখনো বা বিস্ফারিত করে মুখে নানা
রকম শব্দ করতে থাকলো। যেমন- হুঁহুঁ , উফফ
, বাপস ইত্যাদি। আমি অধৈর্য্য হয়ে উঠেছি। এমন সময় হঠাৎ যেন ঘুমের চটকা ভেঙে উঠলেন এরকম ভাবে
বাবা বললেন। বুঝেছি এতক্ষনে , জঙ্গলের ছবি
এঁকেছিস তো ? এই বয়েসেই দারুন এঁকেছিস , খুব ভালো এঁকেছিস। কি ডিটেল ! বাঘ বসে আছে
ঢিবির সামনে ওথ পেতে শিকারের আশায় , আর জিম করবেট একটু পরে এই গাছে উঠে বসবে। দারুন দারুন।
যা সবাইকে দেখিয়ে আয়।
আমি তো সব শুনে
থ। বাবা কি বলে ? বললাম বাবা আমি তো মানুষের
ছবি আঁকতে.... সবে এই অব্দি বলেছি , বাবা
এক ধমকে বলে উঠলেন খবরদার ! কখ্খন মানুষের ছবি আঁকবি না। দুই কানের পাশে হাতের তালুর আঙ্গুল গুলো নাড়তে নাড়তে
, মুখ হাঁ করে চোখের মনি ঘোরাতে ঘোরাতে বলতে থাকলেন মানুষ ভয়ঙ্কর জীব। মানুষ রাক্ষস , মানুষ খোক্ষস। মানুষ হিংস্র - মোর দ্যান এনি এনিম্যাল এন্ড বিস্ট। মানুষ সর্বভুক। অন্য্ কোনো প্রাণী নয়। অন্য্ হিংস্র প্রাণীরাও শুধু খিদে পেলে খায়। মানুষ খিদে না পেলেও খায়। ক্ষুধা ছাড়াও শিকার করে। মানুষ মানুষকেই শিকার করে সবার আগে। নেভার ড্র এ ফিগার অফ এ ম্যান। ওহঃ নো নো নেভার বিকাম এ ম্যান মাই লিটিল সন। কখনো মানুষ হয়ো না।
আমি ভয় পেয়ে দে
ছুটে .... না হলে আরো কত উদাহরণ দিয়ে মানব সভ্যতার সাথে অন্য প্রাণী জগতের তফাৎ বাবা
বুঝাতে তার ঠিক নেই। মানে মানে কেটে পরে ভালো।
এবার গেলাম ছোটোপিসির
ঘরে। মন দিয়ে স্কুলের খাতা দেখছে। বাবারা দিদি বলতো বলে আমরা ছোটরাও ছোটোপিসিকে পিদি
বলে ডাকতাম। পিসির পি আর দিদির দি। কাছে গিয়ে
কিছু না বলে টেবিলে খাতাটা এগিয়ে দিলাম। আস্তে
আস্তে রহস্য মাখা স্বরে বললাম - আমি এঁকেছি।
পিদি বললো , বাহ্
সুন্দর হয়েছে। এটা বেশ ধানের গোলা , আর তার সামনে একটা মুরগি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর পিছনে ওটা কি ? একটা রাক্ষস ধান নিয়ে যেতে আসছে
?
আমি খুব প্রতিবাদ
করে বললাম না না পিদি , এটা একটা মানুষ বসে আছে , আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম, আর ইটা একটা কুকুর। আর ইটা তো লিচু গাছ।
পিদি খাতাটা হাতে
তুলে নিয়ে মন দিয়ে চশমাটা ঠিক করে খাটিয়ে নিয়ে দেখে বললো - ওহ বুঝেছি এটা তো তোমাদের
বিনি বসে আছে। বড়পিসিকে আমরা ছোটরা বিনি বলেই
ডাকতাম। এ নামটা কি করে হয়েছে জানিনা।
আমি কিছু বলার
আগেই পিদি , আরও বলে উঠলো , বিনি বেশ বসে আছে আর ভুট্টু কুকুর ওকে তারা করেছে। বলে হাত টি পেন্সিলটা টেনে নিয়ে এখানে ওখানে কিছুটা
আঁকিবুকি কেটে দিলো। তারপর বললো , দেখো , এবার
বেশ বিনি বলে মনে হচ্ছে।
সেই সময়েই মাঝের
ঘরের ভিতর দিয়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলো স্বয়ং বিনি। আমাদের তার সম্পর্কে কথা বলতে শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো। সরু রোগ চেহারা। টুকটুকে গায়ের রং। সাদা খান শাড়ি পড়া। বাঁ পায়ের ব্যাথায় ঈষৎ বাঁদিকে কাত হয়ে হাটে। মাথার চুল এতো বয়সেও কুচকুচে কালো। বিনির মুখে সন্দেহের চিন্হ ফুটে উঠেছে। দুদিন আগেই গানের স্বরলিপি নিয়ে দুই বোনে তুলকালাম
হয়ে গিয়েছে। তার রেশ চলছে।
বিনি একটু বাঁকা
স্বরে জিজ্ঞাসা করলো আমাকে - দানা ! ওটা কি রে ? কিসের খাতা ? এখানে বলি বিনি ছিল হাবড়ার
স্কুলের আঁকার টিচার। অসাধারণ প্রতিভা। যা খুশি দিয়ে যখন তখন ছবি হোক বা হস্তশিল্প বানিয়ে
ফেলতে তার জুড়ি মেলা ভার। আর ছিল অসাধারণ গানের
গলা। ঠাকুরদার বড়ো আদরের বড়ো মেয়ে। জমিদার বাড়ির আলো। নিয়তি কেড়ে নিয়েছে সব রং। বাল্য বিধবা হয়েই রয়ে গেলেন।
খাতাটা নিজে থেকেই
টেবিল থেকে টেনে নিয়ে চোখের খুব কাছে টেনে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে বললো - এদিকে
আয়। বলে আমার হাত ধরে বড়ো ঘরটার একটা কোনে
নিয়ে গেলো। আমার ছবির ওপর পিদির কারেকশনের ফলে সেটা হয়তো একটু বোঝার উপযোগী হয়েছে ততক্ষনে। বিনি ফিস ফিস করে বললো , এটা তুই এঁকেছিস ? আমি বললাম হ্যাঁ। বিনি চোখ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো পিদি তোকে আমার সম্মন্ধে
কি বলছিলো ?
আমি বললাম হ্যাঁ।
বিনি চোখ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো পিদি তোকে আমার সম্মন্ধে কি বলছিলো ? এখানে বলে রাখি , আমার আঁকা ছবিতে যে মানুষটা এঁকেছিলাম তার চোখগুলো
ছিল অনেকটা পায়রার ডিমের মতো। পরে দেখেছি , নিজের আঁকা ছবি পরে দেখলে , প্রত্যেকবার
অন্যরকম লাগে। তখন বুঝতাম না। সেই ছবি আমার
দেখে আমারই ভয় লাগছিলো।
আমি বললাম, পিদি
বলছিলো খুব ভালো হয়েছে - মানুষের ছবিটা অনেকটা যেন বিনির মতো হয়েছে। আর বলছিলো ভুট্টু তোমাকে তারা করেছে।
ব্যাস। কুকুর যেমন আর একটা বেপাড়ার কুকুরকে দেখে দাঁত খিঁচিয়ে
খানিক্ষন গর্জন করে হ্যাহ্যাহ্য করে , আর মাটি আঁচড়ায়, ঘূর্ণি ঝড় ওঠার আগে যেমন দূর
থেকে একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ শোনা যায় , আর কুরুক্ষেত্রে দুঃশাসনের বুকের রক্ত পান করার
আগে ভীম যেমন হাত উঁচু করে আস্ফালন করেছিল - বিনির চেহারা হয়ে উঠলো এসবের সম্মিলিত
একটা রূপ।
মুখ দিয়ে শুধু
বেরোলো - ওঃ আচ্ছা ! এটা আমি ?? এটা আমি ,
তাই না ? আর ভুট্টু আমাকে তারা করবে ? তাই না ? ভুট্টু তোকে খাবে।
বিনি এবার এক
কদম দু কদম করে পিদির কাছে এগিয়ে আসছে।পিদিও স্কুলের খাতা পেন রেখে সোজা হয়ে বসেছে। আসন্ন রণক্ষেত্র প্রস্তুত।
বিনি বলে চললো
, আমি জমিদার গিরীন্দ্র রায় চৌধুরীর বড় মেয়ে।
আর তুই ? তুই হলি কুলাঙ্গার।মাথার পাকা চুল , এতো ছোট বেণী বাঁধতে প্যারিস না। চোখ কটা। যেন সবটাই সাদা। ভূতের মতো।
গান গাইতে পারিস না। ছবি একটা পারিস
না। বই পড়িস না। নিচ প্রজাতির।
বাবা দয়ালু মানুষ ছিলেন। তোকে বোধ হয়
কুড়িয়ে পেয়েছিলো।
পিদি এতক্ষন হতভম্বের
মতো তাকিয়ে ছিল। যখন একটু বুঝলো আক্রমণের সব
তীর অগ্নিবানের মতো তার দিকে ছুটে আসছে , তখন সেও একটা মোক্ষম অস্ত্র ছেড়ে দিল। উঠে
দাঁড়িয়ে কাপড়ের আচলটা কোমরে গুঁজে নিয়ে বললো - খবরদার ! আমাকে নিয়ে কুৎসা করবে না। মিথ্যেবাদী।
আমি আগে জন্মেছি না তুমি ? আমার আগে
পরে আরও অনেকে আছে। কাজেই অনেক প্রত্যক্ষ ও পারিপার্শ্বিক প্রমান আছে যা প্রমান করে
আমি বাবারই মেয়ে। বাট নট ইউ। তুমি যেহেতু প্রথম , তাই তুমি কিভাবে কি হলে তার
কোনো প্রমান পাওয়া যাচ্ছে না এই মুহূর্তে।
তার জন্য তদন্ত প্রয়োজন।
মুহূর্তে দেখলাম
বিনি বাক্যহারা হয়ে হাত দুটো দুপাশে দোলাচ্ছে , আর পায়ের পাতাটাকে স্প্রিঙের মতো ব্যবহার
করে শরীরটা তার ওপর ওঠাচ্ছে নামাচ্ছে।
দেখবি আমার প্রমান
? বিনি বললো চোখটা কুঁচকে। হাতে যেন সুদর্শন
চক্র ধরা রয়েছে এমন করে দেন হাতের তর্জনী উচুকরে
বলতে থাকলো , পুকুর ধারের লম্বা নারকোল গাছটা আমার লাগানো , কাঁঠাল গাছ দুটো আমি আর
বাবা মাইল লাগিয়েছিলাম। সে সব তোরা জানবি কি
করে ?
বিনিকে থামিয়ে
পিদি বললো নেচে নিয়ে , তারপর হাতে একটা তালি দিয়ে , হেয়ার ইউ আর। সে আমরা জানবো কি করে ? হা হা হা। নারকোল গাছ আর কাঁঠাল গাছে কি প্রমান হয় ?
তবে রে , তুই
আমার জন্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলছিস ? দেখবি তবে ? বিনি আর সুবিধাজনক কোনো উত্তর না পেয়ে
বড়ো ঘরের ছোট খাতে রাখা পাড় বসানো হাতপাখাটা তুলে নিলো। আর নিয়েই পিদি র দিকে তেড়ে গেলো ছাগল তাড়ানোর ভঙ্গিতে। পিডিও ততক্ষনে সম্ভবত আত্মরক্ষার জন্য সামনের টেবিলে
রাখা খবরের কাগজটা মুড়ে লাঠির মতো করে নিয়েছে।
এই লাগে কি সেই লাগে অবস্থা। আমি ভয়ে
কাঁপছি। এই কান্ড অনেক দেখেছি এ গড়াতে গড়াতে
উঠোন অব্দি চলে যেতে পারে। জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি
হতে পারে। কেন ? না , দুজন দুজনকে বিভিন্ন
সময়ে যে উপহারের শাড়ি , কাপ প্লেট , ফুলদানি ইত্যাদি দিয়েছে সেগুলো তার দিকে নিক্ষেপ
করে - এই নাও , এই ফিরিয়ে দিলাম , এটা উপহার না , উপহাস। তাই হ্যাজ নয় হ্যাড করে দিলাম। এসব হবে।
কিন্তু হলোনা।
নিজের ঘর থেকে
দৌড়ে , প্রায় লাফিয়ে ছোটকাকা চলে এসেছে দুজনের মাঝখানে। ট্রাফিক পুলিশের মতো দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে মুখেই আওয়াজ
করে দিলো - পিইইইইক পিইইইইক। মুখে চেঁচিয়ে
বলল - স্টপ , স্টপ আই সে। সবাই চুপ। সুবিধা বুঝে এবার ছোটকাকা , যেন দুটো বাচ্চা মেয়েকে
শাসন করছে সুরে বললো, ছি ছি ছি ছি , ছিঃ !! একটা শিশুর সামনে তোমরা অসামাজিক কাজ
করছো ? অশুদ্ধ ভাষা প্রয়োগ করছো ? তোমরা নাকি নামকরা দিদিমনি , আই মিন রিনাউন্ড টিচার
!! তোমাদের এই অধঃপতন ? এক্ষুনি দুজনের দুজনে
কাছে সরি বলো।
বিনি বললো , কেন
সরি বলবো ? আমার আগে ও বলেছে।
পিদি বললো , সেকি
আমিকি বলেছি ? আমি তো দানার সাথে ছবি নিয়ে কথা বলছিলাম ,
বিনি বললো - মিথ্যে
কথা , সেটা শুধু কথা নয় , আমাকে উদ্দেশ্য করে ব্যঙ্গ করা। দানা সাক্ষি।
আমার দিকে তাকিয়ে বিনি বললো , বল দানা , তোর পিদি আমাকে নিয়ে কি বলেছে ?
পিডি অধৈর্য হয়ে
বললো , যা বলেছি বেশ করেছি , কুটিল মহিলা।
সারাক্ষন সবাইকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে। সকালে
এখনো কারোর জলখাবার খাওয়া হয়নি , বাচ্চা দুটো না খেয়ে রয়েছে , আর উনি যেন খালপাড় থেকে
উঠে এলেন।
এমন সময় ছোটকাকা
আমার দিকেএগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করল , কিরে দানা ! কিসের ছবি এঁকেছিস
? সুর্পনখা বোধের ছবি ?
আমি তো হাঁ। এ আবার কিরকম প্রশ্ন ? কিছু না বুঝে বললাম - না
না কাকা , আমি মানুষের ছবি এঁকেছি।
ছোটকাকা সবে বলেছে
ও আচ্ছা , হঠাৎ আমার সামনে , আর ছোটোকাকার পিছনে ঠ্যং ঠ্যংঠ্যংঠ্যং ঢ্যাং ঢ্যাঙাৎ
, এরকম একটা বাসন ভাঙার শব্দ। আসলে আমার আর ছোটোকাকার কয়েক সেকেন্ডের বাক্কালাপের মাঝে
দুই যুযুধান বীরঙ্গনা সামনের বারান্দায় চলে গেছে।
বিনি সামনের জল রাখার পিতলের খালি গামলা ছুড়েছে পিডির দিকে , তবে কন্ট্রোল্ড
উপায়ে , যাতে গায়ে না লাগে। আর পিদিও জলভর্তি
লোহার বালতির জল ছুড়ে দিয়েছে বিনির দিকে। জলে
আঘাত লাগবে না , তাই ইটা সে ছুড়েছে নিখুঁত লক্ষে। জল ছোড়ার সময় জলসমেত বালতি হাত ছাড়া হয়ে উড়ে গিয়ে পড়েছে নিচের
উঠোনে ঝাঁট দিতে থাকা তরুনের মা'র্ ওপরে। আশ্চর্য
জিমন্যাস্টিক কৌশলে সে প্রায় রিভার্স ভল্ট
দেওয়ায় বালতিটা তার মাথায় না পরে পড়েছে পায়ে।
তার পাশেই জবাগাছ ধরে দাঁড়িয়ে ছিল বাবা।
তার গবেষণা প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো বোধহয়।
বাবার হলিডে বাথটা হয়ে গেলো। বাবাকে
ঘিরে শুয়ে বসে গা চুলকোচ্ছিলো কয়েকটা কুকুর আর হাত চাটছিল দুটো বিড়াল । জল তাদের গায়েও পড়লো। তার থেকেও তারা চমকে গেলো গামলা বালতি একসাথে পড়ার
বিকট আওয়াজে। তারা শুধু ঘ্যাও ঘ্যাও আয়ায়ায়া , আউউউউউ চিৎকার করেই ক্ষান্ত হলো না
, তাদের নেতা ডগ আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিরোর মধ্যে লেগে গেলো তুলকালাম। দুটো বিড়াল সেই দেখে তিড়িং করে লাফিয়ে পড়লো শুয়ে
পড়া তরুনের মায়ের ওপর। পরেই একটা বিড়াল আর
একটাকে মারলো ঠাস করে করে কটা চোর। চুপচুপে ভিজে বাবা সেটা ছাড়ানোর জন্যে এনতার লাথি মেরে যাচ্ছে , একটাও কারোর গায়ে লাগছে না।
তরুনের মা কোঁকাচ্ছে .. উড়ে বাবারে মরে গেলাম।
ছোটকাকা দিশেহারা
হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো আমার দিকে , তুই বলছিলি না
মানুষের ছবি এঁকেছিস ? কখনো আঁকবি না।এরা মানুষ না। রাক্ষস ! এরা
খোক্ষস। ের হিঃস্র জানোয়ারের চেয়েও
ভয়ঙ্কর। উফঃ , ওহঃ নো , হেল্প হেল্প !অবাক
হয়ে দেখি পিদি আর বিনি দুজনেই সেখানে নেই। যে যার ঘরে চলে গেছে। আসলে ভুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা খুব অন্যায় করে ফেলেছে।
যেন উঠোনে পুকুর থেকে সদ্য ধরা মাছ ফেলে রাখা আছে এমন করে গড়াগড়ি খাচ্ছে তরুনের মা। কুকুরে যা স্বভাব , সব কিছু শোঁকা চাই ,ডগও তাই
করলো , এসে তরুনের মাকে একটু শুঁকে নিলো। এর
পরের কাজটাও পিছনের পা উঁচু করে প্রায় করতে গেছিলো , বাবা একটা নারকোলের বেগলো তুলে
ছুঁড়ে দেওয়ায় আর পারলো না। পালালো আর সে বেগলো
গিয়ে লাগলো তরুনের মাকে তুলতে আসা আমার মায়ের পেটে। মায়ের হাঁটার ব্যালান্স এমনিই একটু কম ছিল। ধুপ ধাপ পরে যেত। আর এখন তো কথাই নেই। সোজা গিয়ে পড়লো তরুনের মায়ের ওপর - উপুড় হয়ে। দুজনেই গোঁ
গোঁ করতে থাকলো।
এমন সময় ঘটলো
ক্লাইম্যাক্স। দেখি বারান্দার দুদিক থেকে হাতে
কিসব নিয়ে এগিয়ে আসছে আমার দুই রণক্লান্ত পিসি।
খুব গম্ভীর ভাবে মা আর তরুনের মার্ জোড়া লাগা শরীর দুটোকে দুজনে মাইল আলাদা
করলো। বিনির হাতে তুলো আর লাল ওষুধ , পিডির
হাতে জলের মগ আর অর্নিকার শিশি। দুজনে ধরে
আহত দুজনকে দাঁড় করালো। তারপর দুজনকে খানিকটা
আর্নিকা খাইয়ে দিয়ে বললো হাটো ,ঠিক হয়ে যাবে।
আমি আর ছোটকাকা দুজনের দিকে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। এ কি দেখছি ?
যুদ্ধ শেষ হয়েছে
বেশ খানিক্ষণ। ঠাকুমার বড়ো ঘরে ছোটকাকা বিশেষ মিটিং ডেকেছে বেলা ১২ টায়। আমাকে বলেছে সবাইকে জানিয়ে দিতে। ছোটোকাকাদের নাটকের পেটা ঘন্টাটা ঝোলানো হয়েছে বারান্দার একটা
খুঁটির গায়ে। যেই বারোটা বাজবে ঘড়িতে , ছোটকাকা বললেই আমি ঘন্টায় কাঠের হাতুড়ি দিয়ে
এক বাড়ি দেব। মানে মিটিং শুরু।
মাঝখানের সময়টা
আর কিছু ভালো লাগলো না। বড়োরা সবাই যে যার
ঘরে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। সবারই বসার ভঙ্গি
হুবহু এক - বিছানায় বাবু হয়ে বসে , মাথাটা
নিচু হয়ে প্রায় কোলের কাছে ঝুঁকে পড়েছে।
দুটো হাত দিয়ে মাথাটা ধরা। মাঝে মাঝেই
মাথাটা দুপাশে নড়ে উঠছে আর মুখ দিয়ে ছিঃ ছিঃ
এরকম আওয়াজ হচ্ছে। আমি সাহস করে ছোটোকাকাকে
জিজ্ঞাসা করলাম , আচ্ছা , তোমরা সবাই ঘরে এরকম
ভাবে বসে আছো কেন ? ছোটকাকা প্রথমে ডান হাত দিয়ে মুখটা আড়াল করল , তারপর মিউ মিউ করে বললো , আমরা লজ্জিত , আমরা খুব কুন্ঠিত , আমরা
এখন আত্মসমালোচনা করছি। এ আমাদের বাবার মানে
তোমার ঠাকুরদার শিক্ষা। অন্যায় করলে আত্মসমলোচনা
করতে হয় , ছোটদের কাছেও অনেকসময় ক্ষমা চাইতে হয়।
কি কি ভাবে সেটা করব সেগুলো আমরা একটু সাজিয়ে নিচ্ছি। আমি প্রায় কিছুই বুঝলাম না। আজ সবাই কঠিন কঠিন কথা বলছে। বেশিরভা বুঝতেই পারছি না। অন্য সময় বুঝতে না পারলে জিজ্ঞাসা করি। আজ আর সে ইচ্ছা হলো না। সোজা চলে গেলাম পুকুর ধারে . দেখি সেখানে জ্যাঠামশাই সিঁড়ির একটা ওপরের দিকের
ধাপে বসে আছে। জলে একটা করে নুড়ি ছুড়ে ফেলছে আর সেখানে তৈরী হয় ডেউয়ের তরঙ্গটা একটু একটু করে একজন আর্ একজনকে ধাক্কা দিতে দিতে
পুকুরের ওপারে পৌঁছে যাচ্ছে। সেটা হয়ে সম্পূর্ণ
হয়ে গেলে জ্যাঠামশাই পকুরের ওপারে কাকে হাতছানি দিয়ে যেন ডাকছে। আর বলছে - ফিরে আয়
, ফিরে আয় ...
আমি জ্যাঠামশাইয়ের
পিঠে শুয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বললাম , জ্যাঠামশাই তুমি কাকে ডাকছো ?
জ্যাঠামশাই বললো
- সময় কে। কে ফিরে আসেনা জানো রাজকুমার ?
জ্যাঠামশাই আমাকে
রাজকুমার বলে ডাকতো। আমি উত্তরে বললাম, না
জানিনা।
জ্যাঠামশাই বললো
, সময় গো সময় ! সময় ডাকলেও ফিরে আসেনা।
আমি বললাম জ্যাঠামশাই
মানুষ কি খুব খারাপ জিনিস ? মানুষ কি রাক্ষস , খোক্ষস ? হিংস্র ?
জ্যাঠামশাই হ্যাঁ। আবার মানুষই শ্রেষ্ঠ। আমাকে নিজের পিঠ থেকে সামনের দিকে টেনে নিজের ডানপায়ের
উরুর ওপর বসিয়ে মাথার চুলে চুলকে দিতে দিতে জ্যাঠামশাই বললো , আসলে আজকের এই মানুষ
, এই যে আমরা , এ কিন্তু একদিনে হয়নি। হাজার
হাজার বছর ধরে আমরা এরকম চেহারায় এসে পৌঁছেছি।
এই যে যত জন্তু জানোয়ার দেখছো , পড়ছো এরা সবাই খাদ্য সংগ্রহের তাগিদে , বেঁচে
থাকার দরকারে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করতে করতে ক্রমশ উন্নত হতে থাকে। মানে তাদের মন , শরীর সব পাল্টে যেতে থাকে। একদিনে নয় কিন্তু - হাজার হাজার হাজার বছরের চেষ্টায়। আবার প্রাচীন মানুষ যখন গুহায় থাকতো, তখনও বিভিন্ন
হিংস্র জন্তুর সঙ্গে তাদের লড়াই করতে হতো , বাঁচার জন্য , খাবারের জন্য। বড়ো হলে আরও পর্বে আরও জানবে। তবে এটুকু জানো , এই সব জন্তু জানোয়ারের সব স্বভাবগুলো
মানুষের মনের ভিতর এখনো থেকে গেছে। সেগুলো
হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে পড়ে। তাই মানুষকে হিংস্র
জন্তুর মতো মনে হয়। আসলে মানুষ খুব ভালো। মানুষ হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ-বিদ্যাসাগর , মানুষ হচ্ছে
জগদীশ চন্দ্র-আইনস্টাইন , মানুষই বিবেকানন্দ।
আরও সব মহাপুরুষরা। সবাই তো মানুষই। তারা তাদের মধ্যে বাস করা এই জন্তুর স্বভাবটা আটকে
রাখতে পেরেছিলেন। সবাই পারেনা। তুমি চেষ্টা করো পারবে। মানুষ হওয়ার চেষ্টা করো। মানুষের ছবি আঁকো।
একথা আরও কতক্ষন
চলতো জানিনা। আমি বোধহয় জ্যাঠামশাইয়ের কোলে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ কিসের শব্দে উঠে গিয়ে
দেখি জ্যাঠামশাই আর আমাকে ঘিরে বাড়ির সো বড়োরা দাঁড়িয়ে আছে। পরে জেনেছি বারোটা বেজে গেছে দেখে সবাই আমার খোঁজ
করে , আসলে মিটিংটা ছিল আমার কাছে সবার ক্ষমা চাওয়ার মিটিং। তাই সবাই খুঁজতে খুঁজতে পুকুরে এসে আমাদের পায়।
প্রথমে ছোটোকাকাই
শুরু করলো , বললো দানা , আজ তুমি একটি সুন্দর শিল্পকর্মে ব্রতী হয়েছিল , কিন্তু আমরা
বড়োরা সে কথা ভুলে গিয়ে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই ও অতঃপর নিজেরা অত্যন্ত পাশবিক
আচরণে লিপ্ত হই। এই পর্যন্ত বলে ছোটকাকা ফ্যাল
ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন। কিছু যেন ভুলে গেছে
এরকম ভাবে জিভ বের করলো । তারপর পকেট থেকে
এক টুকরো কাগজ বের করে পড়তে থাকলো , তাই এমতাবস্থায় আমরা সবাই , যারা এখানে একত্রিত
হয়েছি তারা তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে আত্মশুদ্ধির ......
এই অব্দি বলেছে , ঠিক সেই সময় বিনি সেই কথায় বাধা
দিয়ে বললো , তুই যেন স্টেজে বক্তৃতা দিচ্ছিস , বলার মধ্যে ব্যাকরণ আছে কিন্তু আন্তরিকতা
নেই। মার্ লেখাটা এবার আমি পরে শোনাচ্ছি। পিদি
বাধা দিয়ে বললো আমারটা অনেক বেশি শিশু মনের কথা ভেবে লেখা , করুন রসে ভেজা , তাই আমারটা
আমি আগে পরে শোনাচ্ছি , বলে শুরু করলো - হে ভাবীকালের ধারক ও বাহক , হে মহান শিশু
- জাতির মেরুদন্ড ......
এবার আসরে নামলো
জ্যাঠামশাই , পুকুর ঘটে পরে ছিল পালা দেওয়ার পচা বাঁশ। কয়েক ধাপ নেমে সেই বাঁশ তুলে নিলো হাতে। দারুন লাঠি ঘোরাতে পারতো জ্যাঠামশাই। এবার লাঠিটা
মাথার ওপর ঘোরাতে ঘোরাতে বললো , দূর হ , দূর হ পাগলের দল ,হারেরেরেরে...... মুহূর্তে
হওয়ার বেগে সবাই দে দৌড়। আমি হাসছি হো হো করে। জ্যাঠামশাই আমার গালটা ধরে বললো - কেমন দিলাম বলো
! দারুন। আমি আর জ্যাঠামশাই দুজনকে জড়িয়ে ধরলাম। জ্যাঠামশাইয়ের জড়িয়ে ধরা হাতের ফাক
দিয়ে ঘাটের সিঁড়িতে তাকিয়ে দেখি সেখানে পরে রয়েছে আমার আঁকার খাতাটা , তার ওপর আঁকা
একটা সুন্দর মানুষের ছবি। রবীন্দ্রনাথের। ওই ঝামেলার ফাঁকে কখন জ্যাঠামশাই বড়ো ঘরে ঢুকে আমার
আঁকার খাতাটা নিয়ে এসেছিলো কেউ খেয়াল করিনি।
এতক্ষন বসে বসে এঁকে ফেলেছে একটা শ্রেষ্ঠ মানুষের ছবি।