লজ্জা ! একটা ঘটনার তদন্তেই এই অবস্থা ? ১৫ দিন পার - তদন্ত ও বিচারের চেনা চিত্র। পথ দেখাক আদালত।
প্রবীর রায় চৌধুরী - মানুষের ভাষা-র বিশেষ প্রতিবেদন :
আরজিকর হাসপাতালে নৃশংস ও নারকীয় ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার ১৫ দিন পার হয়ে গেল। ভাবা যায় ? পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ও তার প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা একটি মাত্র ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করতে পারছে না। বিশেষত ঘটনাটি কোথায় ঘটেছে ? না, যেটাকে মানুষ দেশের সুরক্ষিততম স্থান গুলির একটি মনে করে - মানে হাসপাতাল। খুন হয়েছে কে ? - একজন অন ডিউটি ডাক্তার। প্রযুক্তির অগ্রগতিতে যেখানে ভারত বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ , এ এই আমাদের জীবনে ঢুকে পড়েছে , অপরাধ বিজ্ঞান ও তার পরীক্ষা নিরীক্ষার উপকরণ যেখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি দ্বারা সমৃদ্ধ, সেখানে এই একটা এত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় যদি তদন্তের এই হাল হয় তাহলে মানুষ দৈনন্দিন জীবনে কিসের উপর ভরসা রাখবে তাদের নিরাপত্তা ও সঠিক বিচারের ব্যাপারে ?
প্রশ্ন উঠছে। দোষী এক না অনেক। ধরা যাক যদি দোষী অনেক হয় , ধরাযাক সেই দোষী বা দোষীরা যদি ক্ষমতাশালীও হয় , ইটা তো খুবই সাধারণ বিষয় যে যেকোনো অপরাধী তার কৃতকর্মের তথ্যপ্রমাণ সাজিয়ে গুছিয়ে কারো জন্য রেখে দেবে না। যে , ভাই এই সব থাকলো - এবার আমায় ধরো। যদি তাও হয় , তাহলে করা তারা ? তাদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছেনা কেন ? যে সমস্ত অপরাধে , অনেক ক্ষেত্রে নানা প্রাকৃতিক কারণে হোক বা ঘটনা জানতে দেরি হওয়ার কারণে তথ্য-প্রমান লুপ্ত বা ফিকে হয়ে যায় - সে সব ঘটনাতেও তো অপরাধী ধরা পরে। আর এখানে তো বহু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রমান , ভিডিও ক্লিপ , সিসিটিভি ফুটেজ , সহপাঠীদের বয়ান ইত্যাদি সাধারণ মিডিয়াদের কাছেও স্পষ্ট।
প্রশ্ন উঠছে সিবিআইকে নিয়েও। মানুষ বলছে , আজ পর্যন্ত কোন অপরাধের তদন্তে তারা সুনির্দিষ্টভাবে অপরাধীকে ধরে দিয়েছে ? গত কয়েক বছরে সারা দেশের কথা ছেড়ে দিন , এই রাজ্যেই বহু মামলার তদন্তের দায়িত্ব আদালত সিবিআই , ইডি , এনআইএ ইত্যাদি তদন্তকারী সংস্থাকে দিয়েছে। কি হয়েছে ? সকাল বিকেল রাত - তারাও ছুতে চলেছেন , পিছনে পিছনে মিডিয়ায় ক্যামেরা ও লাইভ স্রতিমিং নিয়ে ছুটে চলেছে। কি গ্রেপ্তারি হয়েছে ঠিকই , কিন্তু না তো সেই তদন্তগুলির কোনো ফয়সালা হয়েছে , না তো গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের তারা নিশ্চিত ভাবে আদালতে দোষী সাব্যস্ত করতে পেরেছে।
আর আদালত ? এই তদন্তকারী সংস্থাদের দেওয়া রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে কখনো কখনো অসন্তোষ প্রকাশ করেছে , কখনো কখনো করা রায় দিয়েছে , যা আবার হয় ডিভিশন বেঁচে অথবা উচ্চতর আদালতে বাতিল বা স্থগিত হয়ে গিয়েছে। অনেকটা তেল মাখানো বাঁশে বাঁদরের ওঠা নামার মতো। আর এসমস্তকে কাজে লাগিয়েই শাসক - বিরোধীরা রাজনীতির তর্জন গর্জন তীব্র থেকে তীব্রতর করেছে। আদপে এখনো পর্যন্ত নিট ফল জিরো।
এক্ষেত্রে মানুষ যাবে কোথায় ? একমাত্র আশ্রয়স্থল হতে পারে আদালত। এবং মানুষের দেশের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থাগুলি ও আদালতের উপর ভরসা রাখা ছাড়া উপায় নেই। এবং আশাকরি একথা সবাই মানবেন যে এই সব সংস্থায় যে সমস্ত অফিসার ও কর্মীরা আছেন তারা শীর্ষ স্তরের দক্ষতা সম্পন্ন। সঙ্গে এটাও মানবেন যে , এই ধরণের ঘটনার তদন্তে তাদের যেকোনো একজন অফিসারই যথেষ্ঠ অপরাধীকে পাকড়াও করার জন্য।
কিন্তু সমস্যাটা কোথায় তাহলে ? কেও কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিচার চাইলেও তদন্তের অগ্রগতি জানতে পারবে না ? মানে অপরাধ করার পর সব মানবাধিকার ও গোপনীয়তার ধারাগুলি তার বা তাদের উপর বর্তাবে আর যে ক্ষতিগ্রস্থ , অত্যাচারিত সে বা তারা কিছুই জানতে পারবে না শুধু একটা কথা ছাড়া যে , তদন্ত চলছে।
একথা ঠিক বহু কঠোর আইন ও সাজা হয় সত্ত্বেও এই ধরণের নৃশংস ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। শুধুমাত্র এই আরজিকরের ঘটনার পরেই এই রাজ্য ও সারা দেশ জুড়ে এরকম আরো বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেলো। আমরা প্রতিদিনের কাগজে টিভিতে তা দেখছিও। তাই আর দেরি নয়। রাজনৈতিক দোল কি করল মানুষ তা জানতে চায় না। আদালতকে সক্রিয় হতে হবে। গতিশীল হতে হবে। যে আদালত ফাঁসির সাজার মুকুবের শুনানির জন্য রাট ২ টার সময় এজলাস খুলতে পারে , তাদের এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমী ভূমিকা রাখতে হবে , নারীকে , সমাজের মানুষকে তাদের নিরাপদে বাঁচার ও জীবনযাপনের অধিকার সুনিশিচিত করতে হবে। শুধু আক্ষেপ করা আর কিছু করা নিন্দা করে ছেড়ে দিয়ে আর তারিখের পর তারিখ দিয়ে হাত তুলে বসে থাকলে চলবে না। এ অবস্থা বেশিদিন চললে মানুষ তার আত্মরক্ষার অধিকার কার কাছে চাইবে ? সমাজে তো চরম অরাজকতা তৈরী হবে।
প্রতিটি অপরাধে যদি অপরাধী ও দুষ্কৃতী ছাড়া পেয়ে যায় , তবে তো আদালতকেও ভাবতে হবে নতুন করে। আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিভাবে দ্রুত বিচার সুনিশ্চিত করা যায়। আদালতের ব্যবস্থাটাও তো আমাদের , মানুষের উপকারের জন্য , আইন তো সমাজকে সুন্দর , সুষ্ঠ , সুষ্ঠ ও নিরাপদ রাখার জন্য। আইনের সংশোধন ও নতুন আইন তৈরির জন্যি তো মানুষ ভোট দিয়ে আইনসভা তৈরী করে। তদন্তকারী সংস্থা ,পুলিশ কর্মীরা , সাংসদ , বিধায়করা এমনকি আদালতের বিচারপতিরাও আমাদের জনগণের ট্যাক্সের টাকায়
মাইনে পান। কেউ নিজেকে এই বৃত্তের বাইরে ভাববেন না। কেউ সংবিধানের উর্ধে নন। নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে যদি মনে করেন অসুবিধা হচ্ছে সেটা প্রকাশ্যে বলুন। দেশের মানুষ জানুক। আর যদি এভাবেই চলে তাহলে পদত্যাগ করুন। সবাই রাজনীতির বৃত্তে পদত্যাগের
দাবি তোলে। আপনাদের কেউ বলে না। আর নিম্ন আদালত থেকে শীর্ষ আদালত পর্যন্ত - এই সিস্টেমের মধ্যে থাকা অনেকেই এই হচ্ছে হবে , আর রিটায়ারমেন্টের পর আরামে দিন কাটাব এটা ভেবে নিয়েছেন। এ দেশের মানুষকেও ভাবতে হবে এনারাও কারো কাছে দায়বদ্ধ। রাষ্ট্রপতির কাছের থেকে বড়ো কথা দেশের মানুষের কাছে। আর পুড়ে একথা পাশাপাশি উল্লেখ করতেই হবে , দক্ষ , সৎ উদ্যোমী কর্তাব্যক্তি বা বিচারালয়ের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি এখনো অবশ্যই আছেন। তাদের ওপর মানুষের ভরসা এখনো অগাধ। তারা এগিয়ে আসুন , সিস্টেমের ভুলগুলি শুধরে নিয়ে পথ দেখান যাতে মানুষ আপনাদের হাতে নিজেকে সুরক্ষিত মনে করতে পারে।