শুভেন্দু অধিকারী ও আজকের সন্দেশখালী - ঐতিহাসিক। জ্যান্ত শবের দেশে শুধু মশালটা ধরে রাখুন।
সম্পাদকীয় - প্রবীর রায় চৌধুরী
শুভ নববর্ষ যেখানকার মানুষ ভুলে গেছিলো তাদের মাঝে মিশে নতুন বছরকে বরণ করাই তো প্রকৃত জননেতার কাজ। মানুষ যখন নেতা নামক মানুষকে দেখলেই ধান্দাবাজ , চোর , ধর্ষক , লুঠেরা ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল তখন এমন একজনকে দরকার ছিল যে আগুনের উপর দিয়ে হাঁটতে পারে। জ্বালা যন্ত্রনা , লাভ ক্ষতির বিচার করে না। মানুষ যার কাছে ভোটের সংখ্যা নয় - জীবন সংগ্রাম। মেকি সাজানো প্রচার আর প্রকৃত পাশে দাঁড়িয়ে লড়াইয়ের তফাৎটা মানুষ বোঝে। ধরে ফেলে। আর যে মানুষটির মধ্যে এতো সাজগোজ নেই , কিন্তু মাটি আছে , রোদ আছে , ঘাম আছে আর পাশের মানুষটার যন্ত্রণার কথা তার ভাষায় চিৎকার করে বলার ক্ষমতা আছে , তাকে রুখে রাখা কঠিন নয় , অসম্ভব। শুভেন্দু অধিকারী - নন্দীগ্রামের বীর সৈনিক , বহু পথ পার হয়ে আজ সন্দেশখালির রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে প্রমান করলেন জনতার গর্জন যদি ওঠে তাহলে যন্ত্রণার বিসর্জন অবশ্যম্ভাবী - সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
নববর্ষ তো একটি দিন মাত্র।আবার শুধুই একটি দিন নয়। কোথাও গিয়ে থামা।
আবার নতুন করে শুরু করা।
কিন্তু মৃতদেহ কি এতকিছু বোঝে ?
সে তো দিনরাত্রির তফাৎ বোঝে না। তার তো জৈবনিক কোনো প্রয়োজনই আর নেই।
তাই তার কোনো সারা নেই , অনুভূতি নেই।
তাই মৃতদেহের্ কোনো প্রতিবাদও নেই।
মহাশয় ! মৃতদেহ তো বিলক্ষণ দেখেছেন।
জ্যান্ত মৃতদেহ দেখেছেন ? জ্যান্ত মৃতদেহ ? দেখেছেন ?
আরে ধুস ! তাহলে তো আপনি জ্যান্ত মৃতদেহের দেশটাও দেখেন নি।
পাগল ভাবছেন ? দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা ?
একটা জায়গা। চারপাশে অপরূপ প্রকৃতি আর তার সাথে মিশে থাকা সহজ সরল মানুষ। নাই বা থাকুক প্রযুক্তি আর উন্নয়নের দুর্বার গতি (নাকি থাবা ?) , অনেক না থাকার মধ্যেও বেঁচে থাকাটা ছিল। হঠাৎ কি যে হয়ে গেলো ! গরীবগুর্ব-মধ্যবিত্ত জায়গাটা পাল্টে যেতে থাকলো। নতুন নতুন মানুষ। অচেনা চোখ , অচেনা ভাষা - অচেনা তাদের কাজকর্ম। তাদের নাকি অনেক টাকা।
যে ছেলেটা মায়ের সাথে নদীতে বাগদার পিন সংগ্রহ করে বড় হয় গেলো , যে কাকিমা বাবুদের বাড়ি কাজ করে সংসার চালাত , বা যে দিনমজুর বেলা পার করে দুটো আয় করে ভাবত যাক দিনটা তো কেটে গেলো তাদের চোখের সামনে উন্নয়ন হতে থাকলো। কি ? কি ?
মাঠ ঘিরে পার্ক। ড্রেন ভেঙে আবার ড্রেন। নদীর পার দিয়ে সারি সারি ইটভাটা। নদীর চড় চাপিয়ে , জলের মধ্যেথেকে হোটেল। গেস্টহাউস। গ্রামের মাঠে কলকাতার মতো ফ্ল্যাট বাড়ি। নিমেষে। প্রদীপের দৈত্যের মতো। চোখ বুজিয়ে খুললেই দেখো সব পাল্টে গেছে।
তাই তো ! কষ্টের দিন বোধ হয় শেষ হলো।
প্রথম প্রথম এই মানুষগুলো কাজ পেলো এসব জায়গায়। তারপর ? সে গুড়েও বালি।
ও মা ! এবার এ কি দেখি ? রাতে বাড়ির বাগানে ওসব করা ? উরিব্বাপ ! কি বিশাল বিশাল গরু। কোথায় যায় ? সঙ্গে কিছু অচেনা লোক। হাতে বড় টর্চ।
এই কে রে আমার বাগানে ?
উত্তর এলো - কাকু ঘরে চলে যাও . কথা বোলো না।
তবে রে , আমার বাড়ি ঢুকে আমাকে হুমকি ! ব্যাটা চোর ...
কথা শেষ হতেই সামনে অচেনা তিনজন।
বললো - বেশি চিল্লাবেন না।পকেটে মেশিন (বন্দুক ) আছে আমরা এখন থেকে রোজ ই যাবো এখান থেকে।বেশি কিছু করলে চিৎ করে দেব।
চালু হলো। চলতে থাকলো।
হঠাৎ একদিন এক চেনা দিন মজুর বলে বসল - একটা ব্যবসা করবা কাকা ?
কি ব্যবসা ?
একটু নোংরা টাইপের ব্যবসা। হোটেলে কন্ডোম আর মদের বোতল সাপ্লাই দিতি হবে। মদের বোতলে ৩০ টাকা লাভ। রোজ অনেক বোতল লাগে। আর এলাকার মেয়েমানুষ হোটেলে ঢুকলে বাইরে একটু পাহারা দিতে হবে। ঘন্টায় ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা আয়।
কি সর্বনাশ ! এখানে এসব হচ্ছে ?
বেশি কিছু বোলো না কাকা। তুমি না করলে কোরো না। বাধা দিতে এসো না। ওদের অনেক টাকা। আর পকেটে ম্যাশিন নিয়ে ঘোরে। অন্ধকারে চিৎ করে দেবে। কাকিমা তোমারে খুঁজেও পাবে না। তারপর কাকিমারেও তুলে না যাবে।
আর একটা কথা বলি কাকা , তোমার বাড়ি , অনেক বড়ো বাগান। আমাদের গরু গুলো রাখি। তুমি খবর করো না। তোমার কথা কেউ শুনবে না। পাগল বলবে। এমনিতেও তো তোমার আর্থিক অবস্থা ভালো না। লোকে পাগল বলে।
তা তুই কি এখন অনেক টাকার মালিক ? যে এতো বড় বড় কথা বলছিস ?
তা তোমাদের আশীর্বাদে আমি এখন গরু সিন্ডিকেটে ঢুকেছি , রাতে ১২০০ টাকা হয় - গরুর সাথে রাখালের মতো যেতে হয়। গরু গুলোর মুখ সিল করা থাকে - তাই শব্দ হয় না। বিএসএফ চুক্তি করা থাকে। কিছু বলে না। আর দিনের বেলা হোটেলে নোংরা জিনিস সাপ্লাই করে , আর মেয়েছেলে চুক্তি করিয়ে দিয়ে কোনো কোনো দিন ৫০০০-৬০০০ টাকাও আয় হয়ে যায়। আমরা সব সবুর মন্ডলের (নাম পরিবর্তিত) দলে।সৰু ভাইয়ের এখন বিশাল চেন। উপর মহলে ওঠা বসা। বলেছে তোরা যা পপারিস কর। আমি সামলে নেব। আর ভাই তো আমারে ঘর বানিয়ে দেচ্ছে। তোমরাই বলো - জন খেটে কত কষ্ট করেছি। এখন আমি তোমার চাইতেও বড়োলোক। ৩০০০০ টাকার ফোন কিনে দিয়েছি বউরে , একলাখ টাকার বাইক কিনেছি। বেশ ভালো আছি কাকা।
এসব দেখে কিছু মানুষ যে রুখে দাঁড়ায়নি তা নয়। কিন্তু অর্থনীতির নিয়মেই তারা ক্রমশ সংখ্যায় কমে যেতে থাকলো। ক্রমশ এক এক জন একা মানুষ। যে ওদের "ভালো থাকায়" বাধ সাধছে।
এভাবেই চললো। চলতে থাকল। কে জানতো দূর্গা কাকুর মাঠে , যেখানে ছোট বেলা থেকে খেলে বড়ো হলো সবাই , তার এতো দাম ! কে জানতো পাড়ার বিশ্বাস বাড়ির দুই ভাই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে ? কে জানতো ভোটের পাঁচদিন আগেই ভোট হয়ে যাবে। ভোটের দিন রাস্তায় কুকুরটাও বেরোতে ভয় পাবে। বাহিনী দিয়ে কি হবে ? ভোট তো পাঁচদিন আগেই হয়ে গেছে - সৰু আর লম্বু সুদীপের (নাম গুলি পরিবর্তিত ) দল রাতে এসে বলেই গেছে - বাচ্চু দা ভোটের দিন বাড়িতে আরাম করে টিভি দেখো। বাইরে যেতে হবেনা। তারাই তো এখন......
এরপর ? দৈনিক উৎপাত। সঙ্গে বন্ধুত্ব। কেন ?
বুঝিনি।
এক প্রোমোটারের স্ত্রী , হঠাৎই বাড়িতে বেশি আনাগোনা করে। স্ত্রীর সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। সেই প্রোমোটারও রাস্তায় ঘাটে হঠাৎ এই পাগলের সাথে খাতির জমায়। পাশে চলতে থাকে কিছু অচেনা চলে ছোকরার অপরিচিত অশালীন উৎপাত। জীবন ক্রমশ নরক কুন্ডে পরিণত হচ্ছে - এরকম অবস্থায় আসলো প্রস্তাবটা।
সেই প্রোমোটারের কাছ থেকে। ভাই এখানকার পরিবেশ যা হচ্ছে , তোমার মতো ভদ্র মানুষজন পরিবার নিয়ে থাকতে পারবে না। বাড়ীটা বেচে দাও। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি সবুকে বলে। এখনো কিছু দাম পাবে। ছেলেটার একটা ভবিষ্যৎ আছে। না হলে তুমিই যদি না থাকো তাহলে ওদের কি হবে বলো ?
তারপর ? আপত্তি , পাল্টা হুমকি , না হলে জোর করে পাওয়ার অফ এটর্নি সই করিয়ে নেওয়া...
আর হাড় হিম করা কিছু ঠান্ডা কথা - দেখো দাদা , থানা আমার , পুলিশ আমার , রেজিস্ট্রি অফিস আমার , বি.এল.আর.ও আমার , উকিল আমার , কোর্ট আমার - আজ তুমি যে উকিল ঠিক করবা , কাল তারে আমি কিনে নেবো। তুমি কি করবা। তুমি আমার কিসসু করতে পারবা না। সই করো , জলদি সই করো। আর ফোটাকসে জায়গা ছাড়ো।
এভাবেই একটি জায়গার সব মানুষ মৃতদেহ হয়ে গেছে।নিজের চিতায় শুয়ে আছে কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই।
আপনি , শুভেন্দু অধিকারী পারবেন ? এই মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চার করতে ? সন্দেশখালি একা নয়। তার চার পাশের মৃত গ্রাম - আধাগ্রাম - শহরে শুয়ে আছে অসংখ্য জ্যান্ত মৃতদেহ। যাদের প্রাণ আছে। বাঁচার ইচ্ছা নেই।
আজকের সন্দেশখালির সমাবেশ , আপনার এগিয়ে যাওয়া থামলে হবে না। তা সঞ্চারিত হতে হবে মানুষ থেকে মানুষে। যে মানুষদের মধ্যে গর্জে উঠবে এক একটা শুভেন্দু অধিকারী। রাস্তায় , ঘরে।, মাঠে, দোকানে।
এই নববর্ষ , তাই ঐতিহাসিক হয়ে থাকবে শুধু এই কারণে , যে একটি মানুষ শুরুটা করেছিল। আর কে না জানে ভয় যেমন ছোঁয়াচে , সাহসও তেমনি দাবানল স্বরূপ। ছড়াবেই ছড়াবে। আপনি শুধু মশালটা ধরে থাকুন।